রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরানো প্রেমের কবিতা || o bengla shayari ( Rabindranath thakur er romantic poem) ...

Manga Suggestions
0

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বাংলা সাহিত্যিক, কবি, শিল্পী, স্বাধীনতা সেনাবাহক ও শিক্ষক। তিনি বাংলা সাহিত্যের সাধারণ স্বাধীনতামূলক কবি। তাঁর কবিতা, উপন্যাস, নাটক, সংস্কৃতি ও শিক্ষাবোধক গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অন্যতম প্রমুখ অংশ হিসেব করে। তাঁর কবিতার মধ্যে সমৃদ্ধ স্বাধীনতামূলক সূচনা রয়েছে। রবী ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ কবি ও সম্পাদক। সে বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ শ্রেণীর লেখক ছিলেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের নতুন স্বাদ সৃষ্টি করেছেন এবং বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নে গড়ে তুলেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের সাথে বাংলা সংস্কৃতির সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি গুরুদেব নামেও পরিচিত, তিনি ছিলেন একজন বাঙালি বহুভাষী, কবি, সঙ্গীতজ্ঞ এবং ভারতের শিল্পী। তিনিই প্রথম অ-ইউরোপীয় যিনি 1913 সালে তাঁর গীতাঞ্জলি (গানের অফার) কবিতার সংগ্রহের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন। সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে কবিতা, উপন্যাস, ছোট গল্প এবং নাটক। তিনি বাংলা এবং ইংরেজিতে ব্যাপকভাবে লিখেছেন এবং তার রচনাগুলি অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার কবিতা, তার সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য দ্বারা, প্রেম, প্রকৃতি এবং মানুষের অবস্থার ধ্যান করে। রবীন্দ্রসঙ্গীত নামে পরিচিত ঠাকুরের গান বাংলায় জনপ্রিয় এবং শাস্ত্রীয় ও চলচ্চিত্র গান সহ বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়েছে। ঠাকুর একজন দক্ষ চিত্রশিল্পী ও নাট্যকারও ছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে শিক্ষাগবেষণার কেন্দ্র বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষার বিষয়ে তাঁর ধারনা, যা একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিল, ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে গঠনে প্রভাবশালী হয়েছে। ঠাকুরের দর্শন এবং বিশ্বদর্শন ভারতীয় আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য, বিশেষ করে উপনিষদ এবং ভগবদ্গীতা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল। তিনি ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সোচ্চার সমালোচক ছিলেন এবং ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। তার কবিতা "যেখানে মন ভয় ছাড়া" সহ তার কাজগুলি ভারতীয় এবং বাঙালিদের প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। 





এখানে কিছু বিখ্যাত কবিতা রয়েছে যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবদ্দশায় লিখেছিলেন





1. অনন্ত প্রেম (মানসী কাব্যগ্রন্থ )

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
যত শুনি সেই অতীত কাহিনী,
প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলনকথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে
দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া
তোমারি মুরতি এসে,
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।
আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা
কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে,
মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।
আজি সেই চিরদিবসের প্রেম
অবসান লভিয়াছে
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ,
নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে
সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল কবির গীতি



2. স্মৃতি    (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)

যেন কত শত পূর্বজনমের স্মৃতি।
সহস্র হারানো সুখ আছে ও নয়নে,
জন্ম-জন্মান্তের যেন বসন্তের গীতি।
যেন গো আমারি তুমি আত্মবিস্মরণ,
অনন্ত কালের মোর সুখ দুঃখ শোক,
কত নব জগতের কুসুমকানন,
কত নব আকাশের চাঁদের আলোক।
কত দিবসের তুমি বিরহের ব্যথা,
কত রজনীর তুমি প্রণয়ের লাজ,
সেই হাসি সেই অশ্রু সেই সব কথা
মধুর মুরতি ধরি দেখা দিল আজ।
তোমার মুখেতে চেয়ে তাই নিশিদিন
জীবন সুদূরে যেন হতেছে বিলীন।


3. ধ্যান   (মানসী- কাব্যগ্রন্থ)

স্মরণ করি,
বিশ্ববিহীন বিজনে বসিয়া
বরণ করি;
তুমি আছ মোর জীবন মরণ
হরণ করি।
তোমার পাই নে কূল–
আপনা-মাঝারে আপনার প্রেম
তাহারো পাই নে তুল।
উদয়শিখরে সূর্যের মতো
সমস্ত প্রাণ মম
চাহিয়া রয়েছে নিমেষ-নিহত
একটি নয়ন-সম–
অগাধ অপার উদাস দৃষ্টি,
নাহিকো তাহার সীমা।
তুমি যেন ওই আকাশ উদার,
আমি যেন ওই অসীম পাথার,
আকুল করেছে মাঝখানে তার
আনন্দপূর্ণিমা।
তুমি প্রশান্ত চিরনিশিদিন,
আমি অশান্ত বিরামবিহীন
চঞ্চল অনিবার–
যত দূর হেরি দিক্দিগন্তে
তুমি আমি একাকার।




4.প্রথম চুম্বন   (মানসী- কাব্যগ্রন্থ)

স্তব্ধ হল দশ দিক নত করি আঁখি–
বন্ধ করি দিল গান যত ছিল পাখি।
শান্ত হয়ে গেল বায়ু, জলকলস্বর
মুহূর্তে থামিয়া গেল, বনের মর্মর
বনের মর্মের মাঝে মিলাইল ধীরে।
নিস্তরঙ্গ তটিনীর জনশূন্য তীরে
নিঃশব্দে নামিল আসি সায়াহ্নচ্ছায়ায়
নিস্তব্ধ গগনপ্রান্ত নির্বাক্ ধরায়।
সেইক্ষণে বাতায়নে নীরব নির্জন
আমাদের দুজনের প্রথম চুম্বন।
দিক্-দিগন্তরে বাজি উঠিল তখনি
দেবালয়ে আরতির শঙ্খঘণ্টাধ্বনি।
অনন্ত নক্ষত্রলোক উঠিল শিহরি,
আমাদের চক্ষে এল অশ্রুজল ভরি।



5. শেষ বসন্ত

হবে মোর এ আশা পুরাতে–
শুধু এবারের মতো
বসন্তের ফুল যত
যাব মোরা দুজনে কুড়াতে।
তোমার কাননতলে ফাল্গুন আসিবে বারম্বার,
তাহারি একটি শুধু মাগি আমি দুয়ারে তোমার।
বেলা কবে গিয়াছে বৃথাই
এতকাল ভুলে ছিনু তাই।
হঠাৎ তোমার চোখে
দেখিয়াছি সন্ধ্যালোকে
আমার সময় আর নাই।
তাই আমি একে একে গনিতেছি কৃপণের সম
ব্যাকুল সংকোচভরে বসন্তশেষের দিন মম।
ভয় রাখিয়ো না তুমি মনে!
তোমার বিকচ ফুলবনে
দেরি করিব না মিছে,
ফিরে চাহিব না পিছে
দিনশেষে বিদায়ের ক্ষণে।
চাব না তোমার চোখে আঁখিজল পাব আশা করি
রাখিবারে চিরদিন স্মৃতিরে করুণারসে ভরি।
ফিরিয়া যেয়ো না, শোনো শোনো,
সূর্য অস্ত যায় নি এখনো।
সময় রয়েছে বাকি;
সময়েরে দিতে ফাঁকি
ভাবনা রেখো না মনে কোনো।
পাতার আড়াল হতে বিকালের আলোটুকু এসে
আরো কিছুখন ধরে ঝলুক তোমার কালো কেশে।
হাসিয়া মধুর উচ্চহাসে
অকারণ নির্মম উল্লাসে,
বনসরসীর তীরে
ভীরু কাঠবিড়ালিরে
সহসা চকিত কোরো ত্রাসে।
ভুলে-যাওয়া কথাগুলি কানে কানে করায়ে স্মরণ
দিব না মন্থর করি ওই তব চঞ্চল চরণ।
তার পরে যেয়ো তুমি চলে
ঝরা পাতা দ্রুতপদে দোলে,
নীড়ে-ফেরা পাখি যবে
অস্ফুট কাকলিরবে
দিনান্তেরে ক্ষুব্ধ করি তোলে।
বেণুবনচ্ছায়াঘন সন্ধ্যায় তোমার ছবি দূরে
মিলাইবে গোধূলির বাঁশরির সর্বশেষ সুরে।
রাত্রি যবে হবে অন্ধকার
বাতায়নে বসিয়ো তোমার। 
সব ছেড়ে যাব, প্রিয়ে,
সমুখের পথ দিয়ে,
ফিরে দেখা হবে না তো আর।
ফেলে দিয়ো ভোরে-গাঁথা ম্লান মল্লিকার মালাখানি।
সেই হবে স্পর্শ তব, সেই হবে বিদায়ের বাণী।




6. তনু    (কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ )

এ প্রাণ তোমার দেহে হয়েছে উদাসী
শিশিরেতে টলমল ঢলঢল ফুল
টুটে পড়ে থরে থরে যৌবন বিকাশি।
চারি দিকে গুঞ্জরিছে জগৎ আকুল
সারা নিশি সারা দিন ভ্রমর পিপাসী।
ভালোবেসে বায়ু এসে দুলাইছে দুল,
মুখে পড়ে মোহভরে পূর্ণিমার হাসি।
পূর্ণ দেহখানি হতে উঠিছে সুবাস।
মরি মরি কোথা সেই নিভৃত নিলয়,
কোমল শয়নে যেথা ফেলিছে নিশ্বাস
তনু-ঢাকা মধুমাখা বিজন হৃদয়।
ওই দেহখানি বুকে তুলে নেব, বালা,
পঞ্চদশ বসন্তের একগাছি মালা॥




7. ভীরুতা  ( ক্ষণিকা-কাব্যগ্রন্থ  )

শুনিয়ে দিতে তোরে
সাহস নাহি পাই।
মনে মনে হাসবি কিনা
বুঝব কেমন করে?
আপনি হেসে তাই
শুনিয়ে দিয়ে যাই–
ঠাট্টা করে ওড়াই সখী,
নিজের কথাটাই।
হাল্কা তুমি কর পাছে
হাল্কা করি ভাই,
আপন ব্যথাটাই।
সত্য কথা সরলভাবে
শুনিয়ে দিতে তোরে
সাহস নাহি পাই।
অবিশ্বাসে হাসবি কিনা
বুঝব কেমন করে?
মিথ্যা ছলে তাই
শুনিয়ে দিয়ে যাই,
উল্টা করে বলি আমি
সহজ কথাটাই।
ব্যর্থ তুমি কর পাছে
ব্যর্থ করি ভাই,
আপন ব্যথাটাই।
সোহাগ-ভরা প্রাণের কথা
শুনিয়ে দিতে তোরে
সাহস নাহি পাই।
সোহাগ ফিরে পাব কিনা
বুঝব কেমন করে?
কঠিন কথা তাই
শুনিয়ে দিয়ে যাই,
গর্বছলে দীর্ঘ করি
নিজের কথাটাই।
ব্যথা পাছে না পাও তুমি
লুকিয়ে রাখি তাই
নিজের ব্যথাটাই।
ইচ্ছা করে নীরব হয়ে
রহিব তোর কাছে,
সাহস নাহি পাই।
মুখের ‘পরে বুকের কথা
উথ্লে ওঠে পাছে
অনেক কথা তাই
শুনিয়ে দিয়ে যাই,
কথার আড়ে আড়াল থাকে
মনের কথাটাই।
তোমায় ব্যথা লাগিয়ে শুধু
জাগিয়ে তুলি ভাই
আপন ব্যথাটাই।
ইচ্ছা করি সুদূরে যাই,
না আসি তোর কাছে।
সাহস নাহি পাই।
তোমার কাছে ভীরুতা মোর
প্রকাশ হয় রে পাছে
কেবল এসে তাই
দেখা দিয়েই যাই,
স্পর্ধাতলে গোপন করি
মনের কথাটাই।
নিত্য তব নেত্রপাতে
জ্বালিয়ে রাখি ভাই,
আপন ব্যথাটাই।

8. মিলন  (পুরবী- কাব্যগ্রন্থ)

যেখানে এসে গেছে থামি
সেখানে মিলেছিনু সময়হারা
একদা তুমি আর আমি।
চলেছি আজ একা ভেসে
কোথা যে কত দূর দেশে,
তরণী দুলিতেছে ঝড়ে–
এখন কেন মনে পড়ে
যেখানে ধরণীর সীমার শেষে
স্বর্গ আসিয়াছে নামি
সেখানে একদিন মিলেছি এসে
কেবল তুমি আর আমি।
সেখানে বসেছিনু আপন-ভোলা
আমরা দোঁহে পাশে পাশে।
সেদিন বুঝেছিনু কিসের দোলা
দুলিয়া উঠে ঘাসে ঘাসে।
কিসের খুশি উঠে কেঁপে
নিখিল চরাচর ব্যেপে,
কেমনে আলোকের জয়
আঁধারে হল তারাময়,
প্রাণের নিশ্বাস কী মহাবেগে
ছুটেছে দশদিক্গামী–
সেদিন বুঝেছিনু যেদিন জেগে
চাহিনু তুমি আর আমি।
বিজনে বসেছিনু আকাশে চাহি
তোমার হাত নিয়ে হাতে।
দোঁহার কারো মুখে কথাটি নাহি,
নিমেষ নাহি আঁখিপাতে।
সেদিন বুঝেছিনু প্রাণে
ভাষার সীমা কোন্খানে,
বিশ্বহৃদয়ের মাঝে
বাণীর বীণা কোথা বাজে,
কিসের বেদনা সে বনের বুকে
কুসুমে ফোটে দিনযামী–
বুঝিনু যবে দোঁহে ব্যাকুল সুখে
কাঁদিনু তুমি আর আমি।
বুঝিনু কী আগুনে ফাগুন-হাওয়া
গোপনে আপনার দাহে,
কেন-যে অরুণের করুণ চাওয়া
নিজেরে মিলাইতে চাহে,
অকূলে হারাইতে নদী
কেন যে ধায় নিরবধি,
বিজুলি আপনার বাণে
কেন যে আপনারে হানে,
রজনী কী খেলা যে প্রভাত-সনে
খেলিছে পরাজয়কামী–
বুঝিনু যবে দোঁহে পরান-পণে
খেলিনু তুমি আর আমি।


9. বিদায়    (মহুয়া- কাব্যগ্রন্থ)

তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,
চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল–
তুলে নিল দ্রুতরথে
দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
তোমা হতে বহুদূরে।
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়,
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম।
ফিরিবার পথ নাহি;
দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে,
বসন্তবাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রান্তে; বিস্মৃতপ্রদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা-স্বপ্নের মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সব চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়,
সে আমার প্রেম।
তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশে।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
তোমার হয় নি কোনো ক্ষতি
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃত-মুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি
হোক তব সন্ধ্যাবেলা।
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লানস্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগবেগে
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোনো ফুল নৈবেদ্যের থালে।
তোমার মানসভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়,
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আজও তুমি নিজে
হয়তো বা করিবে রচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন।
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।
হে বন্ধু, বিদায়।
মোর লাগি করিয়ো না শোক,
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সেই ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ-রাতে,
যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
তোমারে যা দিয়েছিনু, তার
পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডূষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম।
ওগো তুমি নিরুপম,
হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান;
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়।


10. সোনার তরী

কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হলো সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এ্লো বরষা।
একখানি ছোট ক্ষেত , আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়া মসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাত বেলা–
এ পাড়েতে ছোট ক্ষেত, আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পাড়ে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউ গুলি নিরুপায়
ভাঙ্গে দু-ধারে–
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেও যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
যত চাও তত লও তরণী-‘পরে।
আর আছে?– আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে–
এখন আমারে লও করুণা করে।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই– ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়াছে ভরি।
শ্রাবণ গগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি–

ওই দেহ-পানে চেয়ে পড়ে মোর মনে
নিত্য তোমায় চিত্ত ভরিয়া
আজিকার দিন না ফুরাতে
ওই তনুখানি তব আমি ভালোবাসি।
গভীর সুরে গভীর কথা
জীবন-মরণের স্রোতের ধারা
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top